‘আমার সন্তানকে এনে দাও’

‘আমার সন্তানকে এনে দাও’

আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষ। বোমা ডিসপোজাল ইউনিট বোমা নিষ্ক্রিয় করছে এবং যৌথ বাহিনীর সদস্যদের চলছে উদ্ধার অভিযান। রেস্তোরাঁ থেকে ঠিক দুইশ’ গজ দূরে ৭৯ নম্বর রোডে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড। বেলা সাড়ে ১১টায় এই ব্যারিকেড পেরিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে চাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী। র‌্যাব-পুলিশের বাধা পেয়ে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমার মেয়েকে এনে দেন, আমি আমার সন্তানকে একনজর দেখতে চাই। কেন আমাকে আটকে রাখছেন, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

‘আমার সন্তানকে এনে দাও’

এলিগ্যান্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান রুবা আহম্মেদের একমাত্র মেয়ে অবিন্তা কবির (২০)। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের মায়ামিতে জন্ম নেওয়া অবিন্তা বাবা কবির হোসেনের সঙ্গে সেখানেই বসবাস করেন। মা রুবার আবদার, মায়ের সঙ্গে যেন এবার ঈদের সময়টুকু কাটায়। মায়ের আবদার রাখতে গত ২৭ জুন বাংলাদেশে আসেন অবিন্তা। গত শুক্রবার ইফতারের ঘণ্টাখানেক পর এক বন্ধুর সঙ্গে গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয় যান এবং সেখানে জঙ্গিদের হাতে জিম্মি হয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। রুবা আহম্মেদের পক্ষে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এলিগ্যান্ট গ্রুপের এজিএম লিয়াকত হোসেন।

উদ্ধার অভিযানের পর থেকেই রুবা কখনও ছুটেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে, কখনও সিএমএইচে, আবার কখনও ঘটনাস্থলে। পাগলের মতো ছোটাছুটির ১৮ ঘণ্টা পর জানতে পারেন, তার আদরের মেয়েটি আর বেঁচে নেই। নিষ্ঠুরভাবে তাকে খুন করেছে জঙ্গিরা। মেয়ের লাশ চিহ্নিত করা হয়েছে শুনেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।

বারবার মেয়ের কথা বলছেন, আর মূর্ছা যাচ্ছেন অবিন্তার এক আত্মীয় পুলক আহম্মেদ বলেন, ‘জিম্মির ঘটনা শুনেই রাত থেকে ঘুম নেই অবিন্তার মায়ের। শেষ পর্যন্ত তিনি পেলেন মেয়ের লাশ। অবিন্তার দাদার বাড়ি নোয়াখালী আর মায়ের বাড়ি ঢাকায়। বসবাস করেন গুলশান ২ নম্বরের ৫০ নম্বর বাড়িতে।’

জানা গেছে, লাশ এখন সিএমএইচে রয়েছে। অবিন্তার মামা এলিগ্যান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহম্মেদও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। বাবা কবির হোসেন ও মামা তানভীর আহম্মেদ আজ রোববার দেশে ফিরলেই জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যানের নাতিকেও হত্যা: ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন দুই বান্ধবীসহ ওইদিন হলি আর্টিসানে খেতে যান। লতিফুর রহমানের মেয়ে সিমিন হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে ফারাজ সবার ছোট। ট্রান্সকম কনজুমার প্রডাক্টসের বিপণন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ তাহনুন ইশতিয়াক রিয়াদ বলেন, ‘অত্যন্ত চঞ্চল ও মেধাবী ফারাজ ট্রান্সকম গ্রুপে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজও করছিল। শুক্রবার রাতে নিজেই গাড়ি চালিয়ে গুলশানের ওই ক্যাফেতে যায়। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবার এখন শোকে পাথর।’

নেই ইশরাত আখন্দ: গুলশানের জিম্মি ঘটনায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক ইশরাত আখন্দ। পরিবার তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। ইশরাত ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভসে ছিলেন। একসময় ব্র্যাক নেটের মানবসম্পদ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। কাজ করেছেন গ্রামীণফোন, আর্ট গ্যালারি ও ওয়েস্টিন হোটেলে। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ইশরাত ছিলেন বিশিষ্ট টেলিভিশন সঞ্চালক নবনীতা চৌধুরীর বন্ধু। নবনীতা বন্ধুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, আমার বন্ধু ইশরাত খুব ঘনিষ্ঠভাবে তরুণ চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতেন। সবকিছুতে সবসময় তিনি তরুণ ছেলেমেয়েদের জয়গান গেয়েছেন। ‘ইশরাত, দীর্ঘ পরিকল্পনার কফিটি আমরা এখন হয়তো অন্য কোনো বিশ্বে বসে উপভোগ করবো। তার আগে তোমার কথা ধার করেই বলি, সবাই সুখী থাকুক’- লিখেছেন নবনীতা।

ভারতীয় তরুণী নিহত: জঙ্গিদের হামলায় বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয় তরুণী তারুশি জৈন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ঢাকায় সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি ভারতীয় তরুণী তারুশি অস্ত্রধারীদের হামলায় নিহত হয়েছে।’

তারুশির বন্ধুর বাবা দাবিদার ধানমন্ডির বাসিন্দা রাশেদ হাসান খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় (বার্কলে) অধ্যয়নরত তারুশি আমার ছেলে রইস হাসান খানের বন্ধু। তার বাবার নাম জিয়ান সঞ্জীব, তিনি বাংলাদেশেই ব্যবসা করেন। শুক্রবার ওই রেস্তোরাঁয় আটকা পড়েছিল সে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। -সমকাল।

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment